২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ! খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। উঠেই মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে দিনটা শুরু করলাম। রুমে ফজরের নামাজ আদায় করে এক কাপ গরম গরম কফি হাতে নিয়ে জানালার পাশে বসে পড়লাম। আজকে আমাদের প্লান হলো থিম্পু থেকে পুনাখা ও ফোবজিখা ভ্যালির পার্মিশন নিয়ে অইদিকে চলে যাওয়া। গতকাল ভুটানে ছুটির দিন থাকায় ইমিগ্রেশন অফিস বন্ধ ছিলো।
থিম্পুতে Hotel Kenny এর জানালার পাশে কফি হাতে
আমাদের ড্রাইভার পেমাই সব ম্যানেজ করে দেওয়ার কথা। সকাল ১০ টার কিছুক্ষণ পর পেমা এসে হাজির। তার কাছে আমাদের ৩ জনের পাসপোর্ট দিয়ে দিলাম। সে জানালো ২ ঘন্টার মত সময় লাগতে পারে। এদিকে পেমা পার্মিশন নিতে চলে যাওয়ার পর আমরা সবাই সাথে থাকা শুকনো খাবার ও ফল দিয়ে নাস্তা ও গোসল সেরে নেই। এরপর সবাই ব্যাগ ব্যাগেজ গুছিয়ে রুমেই আড্ডা দিলাম অনেক্ষন। গতকাল যেহেতু থিম্পু ভালোভাবেই ঘুরে দেখেছে তাই আজ আর বের হয়নি। এদিকে ঘড়িতে প্রায় ১২ টা বেজে গেল। পেমার কোন হদিস নেই। ফোন দিয়ে জানতে পারলাম পর্যটক বেশি হওয়ায় আজকে ভীর লেগে আছে, তাই একটু সময় লাগবে। আমরা ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে হোটেলের অভ্যার্থনা কক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দুপুর ২ টার দিকে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে অবশেষে পেমা হাজির।
Hotel Kenny এর অভ্যার্থনা কক্ষে = Hotel Kenny এর সামনে
এবার পুনাখা যাওয়ার পালা। থিম্পুতে আমাদের হোটেলের সামনে বেশ কিছু ছবি তুলে আমরা রওনা দেই পুনাখার উদ্দেশ্যে। থিম্পুতে আজই প্রথম ওয়ার্কিং ডে পেলাম। অন্যদিনের ফাঁকা রাস্তার তুলনায় আজ বেশ মানুষ, দোকানপাটা খোলা, অনেক গাড়ি কিন্তু কোথাও কোনো গ্যাঞ্জাম নেই, চিল্লাপাল্লা নাই। সবাই সবার মত ব্যস্ত ।
কর্মব্যস্ত দিনে থিম্পু শহর কর্মব্যস্ত দিনে থিম্পু শহর কর্মব্যস্ত দিনে থিম্পু শহর
আমাদের গাড়িটা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগুতে লাগলো। প্রথম দিন থেকেই আমরা গাড়িতে ভুটানি গান বেশী শুনছিলাম, সাথে বাংলা গান তো ছিলই। পথিমধ্যে পেমা একটি ভিউ পয়েন্টে গাড়ি থামালো । সেখানে থেকে একটু দূরেই Simtokha Dzong দেখা যাচ্ছিল। এখানে কিছু ছবি তুলে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম।
ভিউ পয়েন্ট থেকে Simtokha Dzong (সিমতোখা জং)
ঘড়িতে তখন প্রায় ৩ টা বেজে গেছে। আবারও আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে চলতে চলতে আধা ঘন্টার মধ্যেই দাচুলা পাস পৌঁছে গেলাম। তখন সেখানে রোদ ছিল। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যেই দৃশ্যপট পালটে গেলো। সূর্যের আলো উধাও হয়ে গেলে ঠান্ডায় হাতের খোলা অংশ যেন জমে যাচ্ছিলো। ভুটানে আসার পর এই প্রথম মাইনাস ডিগ্রি তাপমাত্রার তীব্রতা অনুভব করলাম।
রাস্তার পাশে ফলের দোকান দোচুলা পাসের পথে দোচুলা পাসের পথে
Dochula Pass (দোচুলা পাস): সুখী মানুষের দেশ ভুটানের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান দোচুলা পাস৷ পাহাড়ের চূড়ায় এ জায়গাটি একেবারেই ছবির মতো সাজানো৷ ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে পুনাখার পথে দোচুলা পাসের অবস্থান৷ দেশটির বর্তমান রাজধানী শহর থিম্পু থেকে অতীতের রাজধানী (১৬৩৭-১৯০৭) শহর পুনাখা যেতে মধ্যস্থানে অবস্থিত দোচুলা পাসের উচ্চতা প্রায় ১০,৫০০ ফুট৷ ভুটানের মানুষের কাছে Dochula Pass (দোচুলা পাস) একটি পবিত্র স্থান। ২০০৩ সালে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত ভুটানের সৈন্যদের স্মরণে নির্মিত ১০৮টি স্তম্ভ এখানকার মূল আকর্ষণ। এই পাস থেকে পরিস্কার আকাশে হিমালয়ের কয়েকটি শৃঙ্গ দেখা যায়।
দোচুলা পাসের উপরে দোচুলা পাসের উপরে দোচুলা পাসের উপরে পেছনে দোচুলা পাস (Dochula Pass)
অনেক বাতাস থাকায় ঠান্ডা আরও বেশী লাগতেছিলো। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এই জায়গাতে বরফও পরে। তাই এখানে থাকা অবস্থায় ভারি জামা পড়া উচিত। আকাশ তেমন পরিস্কার না থাকায় আমরা হিমালয়ের শৃঙ্গ দেখতে পাইনি। বেশ কিছুক্ষণ আশেপাশে ঘু্রে ছবি তুললাম।এখানে পাশেই উচুতে আরেকটি মন্দির আছে। সেখানে যেতে অবশ্য টিকেট কাটতে হয়। সম্ভবত ৩০/৫০ রুপি টিকেটের দাম। আমরা সেখানে যাইনি। পাশে একটি ক্যাফেও রয়েছে, ইচ্ছে হলে খেয়ে যেতে পারেন। যেহেতু হাতে সময় কম তাই বেশী দেড়ি না করে গাড়িতে উঠে পুনাখার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
দোচুলা পাসের পাশেই অবস্থিত একটি স্থাপনা দোচুলা পাসের পাশের মন্দির
পুরো ভুটানেই যেন বিশাল সব পাহাড়ের মিলনমেলা। সুরেলা পাহাড়ি নদী, নীল আকাশ, হলুদ আর সবুজের সংমিশ্রণে ঘন সবুজ বন দেখতে দেখতে আমরা প্রথমেই পৌঁছে গেলাম পুনাখায় অবস্থিত চিমি লাখাং ( Chimi Lhakhang ) মন্দিরে। পাহাড় বেয়ে একটু মাটির রাস্তা ধরে গাড়ি নিচের দিকে নেমে যায়। সেখান থেকে হেঁটে চিমি লাখাং মন্দিরে পৌছাতে হয়। সময় লাগে ১০/১৫ মিনিট।
চিমি লাখাং মন্দিরের বাগান চিমি লাখাং মন্দিরের রাস্তা চিমি লাখাং মন্দিরের রাস্তা দূর থেকে চিমি লাখাং মন্দির ( Chimi Lhakhang )
চিমি লাখাং মন্দির (Chimi Lhakhang ):
পুনাখার একটি বিশেষ ভৌতিক জায়গা নামে পরিচিত এই চিমি লাখাং মন্দির। স্থানীয়দের ধারনা যাদের সন্তান হয়না তারা এখানে প্রার্থনা করলে সন্তান হয়। এছাড়াও সন্তানের মঙ্গল প্রার্থনা করে পরিবারের লোকজন এখানে আসেন। এটি একটি বৃত্তাকার পাহাড়ের উপর অবস্থিত এবং ১৪৯৯ সালে ১৪ তম প্রধান পুরোহিত Ngawang Choegyel দ্বারা নির্মিত হয়েছিল যিনি অতিমানবিক এক পাগল (সাধু) Drukpa Kunley দ্বারা আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন, Drukpa Kunley শুরুতে ছোট্ট আকারে এটি নির্মাণ করেছিলেন।
মন্দিরের পাশে বাচ্চারা মন্দিরের পাশে বাচ্চারা Handycraft চিমি লাখাং মন্দির
পেমা আমাদের পাহাড়ের নিচে (যেই পাহারে মন্দির অবস্থিত) নামিয়ে নিল। আমরা হেঁটে উপরে চলে গেলাম। রাস্তার দুই পাশে কমলা বাগান। যদিও এখন কমলার দেখা পেলাম না। যাওয়ার পথে বিদেশি কয়েকজন পর্যটক দেখলাম। রাস্তার পাশেই হাতের তৈরী নানা জিনিস নিয়ে বসে আছে বিক্রির জন্য। উপরে উঠে দেখলাম বাচ্চারা খেলাধুলা করতেছে। কিছুক্ষন ছবি তোলে নিচে গাড়িতে নেমে এলাম। এবার আমাদের যাত্রা শুরু পুনাখা জং এর দিকে।
অল্প সময়ের মধ্যেই পুনাখা জং এর কাছে পৌঁছে গেলাম।
পুনাখা জং (Punakha Dzong):
পাহাড়ের পর পাহাড়ের সোন্দর্য দেখতে দেখতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবেন ঠিক সেই মুহূর্তে মো চু (মাতা) আর ফো চু (পিতা) নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত পুনাখা জং-এর কাছে এসে মন চঞ্চল হয়ে উঠবে। সহদর দুই নদী মো চু আর ফো চুযেখান এসে মিশেছে ঠিক সেইখানে দুই নদীকে ঘিরে পুনাখা জং। দূর থেকে নদীর সঙ্গমস্থল আর পুনাখা জং-এর প্যানারোমা দৃশ্য অসাধারণ।
পুনাখার পথে পুনাখার পথে পুনাখা জং পুনাখা জং (Punakha Dzong)
পুনাখা জং (পুংতাং ডিছেন ফোটরাং জং হিসেবেও পরিচিত) (যার অর্থ পরম সুখময় প্রাসাদ। এটি আসলে পুনাখার প্রশাসনিক কেন্দ্র। প্রাসাদটি ১৭৩৭-৩৮ সালে যাবদ্রারং রিনপোছে দ্বারা নির্মিত হয়েছিল যার স্থপতি ছিলেন নাগাওয়াং নামগিয়াল।
১৯৫৫ পর্যন্ত, যখন থিম্পুতে রাজধানী সরে আসে, পুনাখা জং ভূটান সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। এটাকে ভুটানের ঐতিহ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউনেস্কো।
পুনাখার জং-এর শৈল্পিকতা, স্বচ্ছ জলের বহতা পাহাড়ী নদী, নদীর উপরে কাঠের ঝুলন্ত সেতু সত্যিই অসাধারণ।
পেছনে পুনাখা জং পুনাখা জং এর পাশে পুনাখা জং এর কাঠের ব্রিজ
কাঠের ব্রিজ থেকে পুনাখা জং পুনাখা জং এর গেইট
বেশ কিছুক্ষণ নদীর ওপার থেকে জং এর সৌন্দর্য দেখলাম। এর পর পাশেই মো চু ও ফো চু নদীর সঙ্গমস্থলের উপরে অবস্থিত কারুকার্যময় কাঠের সেতু পেড়িয়ে জং এর কাছে চলে গেলাম। বিশাল বড় আকৃতির। দেয়ালের বিভিন্ন কারুকাজ মুগ্ধ করার মত। ভেতরটা ঘুরে দেখার জন্য বেশ সময়ের প্রয়োজন। ভেতরে প্রবেশ করলে ৩০০ রুপি দিয়ে টিকিট কাটতে হবে। আমাদের হাতে সময় কম ছিল এবং ইতিহাস ঐতিহ্য দেখার তেমন আগ্রহ না থাকায় জং এর পাশের রাস্তা ধরে মিনিট দশেক হেঁটে চলে গেলাম পুনাখার আরেক দর্শনীয় স্থান সাসপেনশন ব্রিজের কাছে। হেঁটে যাওয়ার পথ টা অসাধারণ। এক পাশে সাজানো সবুজ বৃক্ষের বাগান। অন্যপাশে বয়ে চলা সচ্ছ জলের নদী। আমরা যাওয়ার পথের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সাসপেনশন ব্রিজের কাছে চলে গেলাম।
পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজের পথে পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজের পথে

পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ (Punakha Suspension Bridge):
ফো চু নদীর উপর নির্মিত এটি ভুটানের সব থেকে বড় সাসপেনশন ব্রিজ। এটি মুলত ঝুলন্ত সেতু। নদীর মাঝখানে কোন খুটি ব্যবহার করা হয়নি। ব্রিজটি এবং এর নির্মাণশৈলী দেখতে খুবই চমৎকার। পুনাখা গিয়ে এই ব্রিজ না দেখলে আপনার ভ্রমণে অপূর্ণতা থেকে যাবে।
এপার থেকে ওপারে পাহারের উপর ছোট ছোট সুন্দর বাড়ি, সবুজ ও হলুদাভ সবুজ ক্ষেত মনোমুগ্ধকর। নিচে বয়ে যাওয়া স্বর্গীয় নদীটার নাম ফো চু।
পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ

ব্রিজের রেলিং এ বিভিন্ন রঙয়ের প্রার্থনা পতাকা আটানো। বাতাসে পতাকালো সুন্দরভাবে উড়ছিল। ব্রিজে যাওয়ার শুরুতে তেমন মানুষজন ছিল না। ফাকাই পেয়েছিলাম। মুহুর্তেই দেশ বিদেশের অনেক পর্যটক জড়ো হয়ে গেল। আমরা সেখানে ছবি তুললাম । ব্রিজ দিয়ে হেঁটে গেলাম কিছুদূর পর্যন্ত। এদিকে পেমা কল দিয়ে জানালো আমরা কতদূর! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় ও হাতে সময় কম থাকায় ব্রিজের উপারে আর যাওয়া হয়নি। বয়ে চলা বাতাসের ঠান্ডা আদর, নিচে বয়ে চলা ফো চু নদীর অপার্থিব রঙ এবং চারপাশের অসাধারণ দৃশ্যকে না চাইলেও বিদায় জানাতে হলো। কারণ আমরা আজ পুনাখা থাকবো না, রাতে ফোবজিখাতে চলে যাব। শেষ বিকেলের আলোয়, ঠিক সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্তে ফো চু ও মো চু নদী এবং পাশেই পুনাখা জং এর অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করে ফোবজিখার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। এভাবেই শেষ হলো ভুটানের আরো একটি দিন…
ভুটান ভ্রমণের অন্যান্য পর্বসমূহঃ
- সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ – ঢাকা টু থিম্পু: সুখী মানুষের দেশে (১ম পর্ব)
- ভুটানের রাজধানী থিম্পু ভ্রমণ: সুখী মানুষের দেশে (২য় পর্ব)
- ভুটান ট্যুর প্লান, গাড়ি, থাকা খাওয়া, খরচ ও বিশেষ টিপস: সুখী মানুষের দেশে (বিশেষ পর্ব)